হাওরে সূর্যমুখী চাষ নিয়ে কয়েক মাস ধরে দর্শনার্থীদের মধ্যে উন্মাদনা তৈরি হলেও কৃষকের জন্য এই বীজ এখন তৈরি করেছে বিপত্তি।
কৃষি বিভাগ চাষিদের এই বীজ চাষে উৎসাহ দিয়েছে বিনা মূল্যে বীজ আর সার দিয়ে। কৃষক ঘরে ফসল তুলেছে যখন বীজ বিক্রি করতে পারছে না, তখন তাদের পাশে দাঁড়ায়নি কৃষি বিভাগ।
এই বীজ দিয়ে তেল ভাঙানোর ব্যবস্থা নেই জেলায়। বাজারে বীজ নিয়ে গেলে ব্যবসায়ীরা যে দাম বলেন, তাতে চাষের খরচই ওঠে না। এ অবস্থায় কৃষকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ।
চাষিদের এই ক্ষোভের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা কৃষি সম্প্রসারণের উপপরিচালক ছাইফুল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সূর্যমুখীর বীজ এ মুহূর্তে বিক্রি করার করার ক্ষেত্রে সমস্যা হলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেগুলো বিক্রির ব্যবস্থা আমরাই করে দেব। যে সমস্যা এখন হচ্ছে, সেটা কিছুদিনের মধ্যেই সমাধান হবে।’
কৃষকদের এই তথ্য জানানো হয়েছে বলেও দাবি করেছেন তিনি। যদিও নিউজবাংলার সঙ্গে যে কজন চাষি কথা বলেছেন, তাদের কেউই এ ধরনের তথ্য দেননি।
কেবল হাওর নয়, জেলার ১৩টি উপজেলাতেই কম-বেশি চাষ হয়েছে। ৩৩৫ হেক্টর জমিতে এই তেলবীজের ক্ষেতগুলো গত কয়েক মাস ধরেই এলাকাবাসী ও দূরের মানুষদের আগ্রহের বস্তু হয়ে রয়েছে।
দল বেঁধে ছবি তুলতে গিয়ে কখনও কখনও গাছের ক্ষতিও করেছে তারা। কেউ আবার কৃষকের ক্ষতি করে ফুলও ছিঁড়ে নিয়ে এসেছে।
ফুল আসার পর কৃষকের বিরক্তি এ কারণে ছিল ছবি তুলতে আসা মানুষদের ভিড় নিয়ে। পাহারা দিয়েও রাখতে হতো জমি।
কদিন আগে কালবৈশাখি অনেক ক্ষেতের ফুল নষ্ট করে দিয়েছে। তবে যারা ফসল ঘরে তুলতে পেরেছেন, তারাও যে স্বস্তিতে আছেন, তা নয়।
নতুন ফসল হওয়ায় এই বীজ নিয়ে কী করতে হবে, তা-ও বুঝে উঠতে পারছে না কৃষকেরা। পাওয়া যাচ্ছে না ক্রেতা। বাজারে নিয়ে গেলেও কেউ জিজ্ঞেস করে না বলে জানিয়েছেন তারা।
বিক্রি না করতে পেরে বীজ ভাঙিয়ে তেল বানানোর চেষ্টাও সফল হচ্ছে না। যে মেশিন দিয়ে সরিষা ভাঙানো হয়, সেটা দিয়ে সূর্যমুখী ভাঙতে গেলে পরিমাণে অনেক কম তেল পাওয়া যাচ্ছে।
জেলার কৃষি কর্মকর্তারা জানান, সূর্যমুখী ভাঙানোর মেশিন কিশোরগঞ্জে নেই। পরিমাণে সঠিক তেল পেতে হলে বা বীজের ন্যায্যমূল্য পেতে চাইলে যেতে হবে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে।
কিন্তু একেকজন কৃষকের যে পরিমাণ বীজ আছে, সেগুলো নিয়ে রূপগঞ্জে আসাও লাভজনক হওয়ার কথা না।
মিঠামইন উপজেলার মহিষারকান্দি বেড়িবাঁধ এলাকায় ৪০ শতাংশ জমিতে সূর্যমুখীর চাষ করেছিলেন বাহাউদ্দীন।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কৃষি অফিস আমরারে বিনা পয়সায় বীজ আর সার দিছে। এর লাইগ্যা সূর্যমুখির চাষ করছিলাম।
‘সারা বছর পাহারা দেয়া ফসল ঘর তুইল্যা বিপদে পড়ছি। ছয় মণ বীজ আছে আমার ঘরো। কিন্তু কেমনে কী করাম কিছুই বুঝতাছি না। কই বেচন যাইব এইডাও জানি না। কেউ জিগায়ও না।
‘উপায় না পায়া অহন এক কেজি, দুই কেজি কইরা যারা পক্ষী (পাখি) পালে হেরার কাছে বেচতাছি। ভাঙানোরও জাগাও পাইতাছি না।’
এই চাষি বলেন, ‘জমিত ফুল আওনের (আসার) পরে যেমনে মাইনষে দেখত আইছিন, সেইবালা (সে সময়) খুব ভালা লাগত। কিন্তু কেডা জানত, পরে এই অবস্থা হইব। এই ফসল ফলায়া আমি খুবই ক্ষতিগ্রস্ত।’
ইটনা উপজেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নের ময়নাহাটি হাওরে এক একর জমিতে সূর্যমুখীর চাষ করেছিলেন আবদুল হেকিম। তিনি বলেন, ‘ফসল বালাই অইছে। কিন্তু এই বীজ লইয়া কিবা কী করবাম তা বুঝতাছি না। ধানের বেপারী তো হারাদিনই আয়ে। কিন্তু সূর্যমুখী কিনত কেউ আয়ে না।’
পাকুন্দিয়া উপজেলার আদিত্যপাশা এলাকার কৃষক মো. শফিক ও জাকির হোসেন সূর্যমুখীর চাষ করেছিলেন ৩০ শতাংশ জমিতে। ফলন খুব খুব ভালো হয়েছে। তবে ক্রেতা পাচ্ছেন না তারাও।
মিঠামইনের কুনকুনি হাওরে তিন একর জমিতে ফসল ফলানো মজিবুর রহমান ফসল ঘরে তুলতে পারেননি কালবৈশাখির কারণে।
তিনি বলেন, ‘ঝড়ে আমার সব শেষ। জমিতে ফসল পাওনের কথা ৬০ মণ। পাইছি না ছয় মণও।’
মজিবুর জানান, তার ৪০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে এই ফসল চাষ করে।
নিকলী সদর ইউনিয়নের চারিদ্বার এলাকার পাটছাড়া কান্দায় ৭৫ শতাংশ জমিতে চাষ করেছিলেন মিয়া হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি ফসল ঘরই আনতাম পারছি না। জমিতেই শেষ। হেই বালায় পর্যটকদের ভিড় বেশি বাইড়া গেছিল। সামলাতাম না পাইরা না টেহা নেয়া ছবি তুলতাম দিছি।
‘চাষ করছিলাম ফসলের আশায়। কিন্তু আর কোনো উপায় আছিন না।’
কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণের উপপরিচালক ছাইফুল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সূর্যমুখী পুরো বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন ফসল হওয়ায় কৃষকেরা একটু সমস্যায় পড়েছে। তার মধ্যে আবার ঝড়েও ক্ষতি করেছে।’
‘সরিষা যে ঘানিতে ভাঙে সেখানেও সূর্যমুখী ভাঙানো যায় তবে পরিমাণে তেলটা কম পাওয়া যায়। সূর্যমুখী ভাঙানোর জন্য আলাদা স্পেশালাইজড মেশিন রয়েছে, তবে কিশোরগঞ্জে সেটা এখনও আসেনি।’
তাহলে কৃষক এখন কী করবে, এমন প্রশ্নে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে একটা অয়েল মিল রয়েছে। তারা বাণিজ্যিকভাবে সূর্যমুখী কিনে ভাঙায়। আমরা সেখানেও যোগাযোগ করছি। কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পায়, আমরা সেই উদ্যোগ নিচ্ছি।’